ভাষা

Nadim Sir 
01316-903472

ভাষা 

মানুষের জন্মের পর থেকেই সে ভাষার সাথে পরিচিত না । মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠধ্বনি এবং হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ইঙ্গিত করে থাকে । 
কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ যত বেশি পরিমান মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, ইঙ্গিতের সাহায্যে ঠিক ততটুকু পারে না । কণ্ঠের সাহায্যে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ভাবও প্রকাশ করতে সমর্থ হয় । কণ্ঠধ্বনি বলতে মুখগহবর, কণ্ঠ, নাক ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত বোধগম্য ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে বোঝায় । 
গলনালি, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিহবা, তালু, দাঁত,নাক ইত্যাদি বাক প্রত্যঙ্গকে এক কথায় বলে বাগযন্ত্র ।


বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে । 

ভাষাকে ভাবের বাহন বলা হয়। স্থান- কাল-পাত্র ভেদে ভাষার পরিবর্তন হয়েছে । এই পরিবর্তনশীলতাকে প্রবাহমান নদীর সাথে তুলনা করা হয়েছে । অর্থপূর্ণ ধ্বনিই হচ্ছে ভাষার প্রাণ। পশু বা পাখির ডাককে ভাষা বলা হয় না কারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য বলে।  বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে বাংলা একটি ভাষা। বিভিন্ন  ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ এবং ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খন্ড,  উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের ভাষা বাংলা। আসামি ভাষা আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষা।  আসাম রাজ্যের বরাক উপতক্যার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা।

কোন দেশের সংবিধানে স্বীকৃত ভাষাকে রাস্ট্রভাষা বলে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথমভাগের তৃতীয় অনুচ্ছেদে লেখা আছে প্রজাতন্ত্রের রাস্ট্রভাষা বাংলা। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি লোকের ভাষা বাংলা।


স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভাষার রুপভেদ দেখা দেয় । জন্মলগ্ন থেকে মায়ের কাছথেকে যে ভাষা শেখা হয় তাকে মাতৃভাষা বলে । বাংলা আমদের মাতৃভাষা । আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-গোত্রের বসবাস। আর্য্য, মৌর্য্য, গুপ্ত, পাল, সেন,তুর্কি, সুলতানি আমল,মুগল, ইংরেজ, পাকিস্তান এরপর আমাদের স্বাধিন বাংলাদেশ । আদিকাল থেকে এদেশ বহিরাগত শাসকগোষ্ঠি দ্বারা শাসিত হয়েছে । বাংলা সম্পদে উন্নত হওয়ায় এই বহিরাগত শাসক এবং  বিভিন্ন জাতির লোকেরা এখানে ব্যাবসা বাণিজ্য করতে এসেছে । ফলে আমাদের ভাষায় বিচিত্র ভাষা এবং সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে। কিন্তু বাঙ্গালি- জাতিয়তাবাদ ,   ঐতিহ্য, সংস্কৃতি- কৃষ্টি আদি ধারা বজায় রেখে চলছে । এদেশের জনগোষ্ঠী বাংলায় কথা বললেও চাকমারা যে ভাষায় কথা বলে তার নাম চাংমা, গারো  জনগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে তার নাম আচিক। চিনারা ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলে। 

ভারতবর্ষের মৌলিক লিপি ব্রাহ্মী লিপি, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের সময়ে ব্রাহ্মী উদ্ভব হয় । মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত লিপি ব্রাহ্মীলিপির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ।ব্রাহ্মলীপির কুটিল রুপ থেকে বাংলা এসেছে । ব্রাহ্মী লিপি থেকেই বাংলা লিপি ও বর্ণমালার উদ্ভব হয়। অস্টম খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমা লিপি, মধ্যভারতীয় লিপি ও পূর্ব লিপি জন্ম হয় । নবম শতাব্দীতে পালবংশীয় রাজা নারায়ন পালের তাম্রশাসনে বাংলা লিপির সুস্পষ্ট নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়।সেন রাজাদের যুগে বাংলা লিপির গঠনকার্য শুরু হয় । পাঠান যুগে বাংলা লিপি মোটামুটি স্থায়ীরুপ লাভ করে । 



পণ্ডিতগনের মতে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০-৩৫০০ পর্যন্ত ভারত এবং ইউরোপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রচলিত ছিল যে ভাষাটি, তার নাম 'ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা' । ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার শাখা ২টি যথা কেন্তম ও শতম । বাংলা ভাষার বয়স ১৪০০ বছর । 
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে । 


বাংলা ভাষা রীতি 

বাংলা ভাষারীতিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি লৈখিক ও অপরটি মৌখিক। এই দুই রীতি অনুসারে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিম্নের চার্টে এটি দেখানো হলোঃ


বাংলা, ইংরেজি, আরবি, হিন্দি প্রভৃতি ভাষার মৌখিক বা কথ্য এবং লৈখিক বা লেখ্য এই দুটি রূপ দেখা যায়। ভাষার মৌখিক রূপের আবার রয়েছে একাধিক রীতি।
যেমন :
১. প্রমিত রীতি / Standard colloquial language
২. আঞ্চলিক কথ্য রীতি / Regional Colloquial Style
বাংলা ভাষার লৈখিক বা লেখা রূপেরও রয়েছে দুটি রীতি।


যেমন :
১. চলতি রীতি / Standard colloquial language
২. সাধুরীতি / Regional written form


সাধু রীতি


    সাধু পণ্ডিতদের দ্বারা লিখিত ভাষাই সাধুরীতির ভাষা। সাধুরীতির বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:


ক) বাংলা লেখ্য সাধুরীতি সুনির্ধারিত ব্যাকরণের নিয়ম অনুসরণ করে চলে এবং এর 

      পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট।
খ) এ রীতি গুরুগম্ভীর ও তৎসম শব্দবহুল।
গ) সাধুরীতি নাটকের সংলাপ ও 
বক্তৃতার অনুপযোগী।
ঘ) এ রীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ এক বিশেষ গঠনপদ্ধতি মেনে চলে।

চলিত রীতি


লেখক প্রমথ চৌধুরীকে চলিত গদ্যের জনক বলা হয়। বিশিষ্ট লেখক ও ব্যাকরণবিদগণ যে শিষ্টভাষা রীতি তৈরি করলেন তাই চলিত রীতি। চলিত রীতির বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:


ক) চলিত রীতি পরিবর্তনশীল। একশ বছর আগে যে চলিত রীতি সে যুগের শিষ্ট ও ভদ্রজনের কথিত          ভাষা বা মুখের বুলি হিসেবে প্রচলিত ছিল, কালের প্রবাহে বর্তমানে তা অনেকটা পরিবর্তিত রূপ          লাভ করেছে।
খ) এ রীতি তদ্ভব শব্দবহুল।
গ) চলিত রীতি সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য এবং বক্তৃতার, আলাপ-আলোচনা ও নাট্যসংলাপের জন্য             বেশি উপযোগী।
ঘ) সাধুরীতিতে ব্যবহৃত সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ চলিত রীতিতে পরিবর্তিত ও সহজতর রূপ লাভ করে।            বহু বিশেষ্য ও বিশেষণের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে।


আঞ্চলিক কথ্য রীতি


সব ভাষারই আঞ্চলিক রূপের বৈচিত্র্য থাকে, বাংলা ভাষারও তা আছে। বিভিন্ন অঞ্চলে কথিত রীতির বিভিন্নতা লক্ষিত হয়; আবার কোথাও কোথাও কারো কারো উচ্চারণে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার মিশ্রণও লক্ষ্য করা যায়।


সাধুরীতি ও চলিত রীতির নমুনা


কাজী ইমদাদুল হক ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুজন লেখকের রচনা থেকে সাধু ও চলিত রীতির পার্থক্য দেখা যেতে পারে। যেমন:


ক.সাধুরীতি


পরদিন প্রাতে হেডমাস্টার সাহেবের প্রস্তুত লিস্ট অনুসারে যে তিনজন শিক্ষক সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার অনুমতি পাইয়াছিলেন, তাঁহারা আটটার পূর্বেই ডাক-বাংলায় উপস্থিত হইলেন। একটু পরে আবদুল্লাহ আসিয়া হাজির হইল। তাহাকে দেখিয়া একজন শিক্ষক জিজ্ঞাসা করিলেন-আপনি যে! আপনার নাম তো হেডমাস্টার লিস্টে দেন নাই।  

- কাজী ইমদাদুল হক

খ.চলিত রীতি



পুল পেরিয়ে সামনে একটা বাঁশ বাগান পড়ল। তারি মধ্য দিয়ে রাস্তা। মচমচ করে শুকনো বাঁশ পাতার রাশ ও বাঁশের খোসা জুতোর নিচে ভেঙে যেতে লাগল। পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় বুনো গাছপালা লতা ঝোপের ঘন সমাবেশ। সমস্ত ঝোপটার মাথা জুড়ে সাদা সাদা তুলোর মতো রাধালতার ফুল ফুটে রয়েছে। 
- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়



ওপরের 'ক' ও 'খ' অনুচ্ছেদ দুটির ভাষার উপাদানে সাধু ও চলিত রীতির পার্থক্য নীচে দেখানো হলো 


পদ
সাধু
চলিত
বিশেষ্য
বিশেষ্য
বিশেষণ
বিশেষণ
সর্বনাম
সর্বনাম
ক্রিয়া
ক্রিয়া
ক্রিয়া
ক্রিয়া
ক্রিয়া
ক্রিয়া
ক্রিয়া
অব্যয়
অব্যয়
মস্তক
জুতা
শুষ্ক
বন্য
তাঁহারা/উহারা
তাহার/তাঁহার
করিবার
পাইয়াছিলেন
হইলেন
আসিয়া
হইল
দেখিয়া
করিলেন
পূর্বেই
সহিত
মাথা
জুতো
শুকনো
 বুনো
তাঁরা/ওঁরা
তার/তাঁর
করবার
পেয়েছিলেন
হলেন
এসে
হলো/হল
দেখে
করলেন
আগেই
সঙ্গে/সাথে





মন্তব্যসমূহ

  1. ভাষা সংক্রান্ত সকল বহুনির্বাচনী প্রশ্নসমূহের উত্তর এই ব্লগে রয়েছে। তাই মনোযোগ সহকারে এই ভাষা সংক্রান্ত ব্লগটি পড়ার অনুরোধ করছি ।
    অনেক অনেক ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ